Breaking News

মহাকাশ রাজত্বে বাংলাদেশ



সব অনিশ্চয়তা আর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে মহাকাশ রাজত্বের জন্য যাত্রা করেছে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। নতুন সময় অনুযায়ী বাংলাদেশ সময় শনিবার ভোররাত ২টা ১৪ মিনিটে এটি উৎক্ষেপিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে।
মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সের ‘ফ্যালকন-৯’ রকেটটি বাংলাদেশ সময় শনিবার ভোররাত ২টা ৪৭ মিনিটে এক টুকরো বাংলাদেশকে রেখে আসে তার নিজস্ব কক্ষপথে। ঐতিহাসিক সেই মুহুর্তে ভিডিও বার্তায় দেশবাসীকে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণের সময় কেনেডি স্পেস সেন্টারে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা ও বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়।

এর আগে গতকাল শুক্রবার ভোররাত ২টা ১২ মিনিট থেকে ৪টা ২২ মিনিটের মধ্যে স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণের কথা ছিল। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও উৎক্ষেপণের মিনিট খানেক আগে তা স্থগিত করা হয়।

ওই দিনও কেনেডি স্পেস সেন্টারে ছিলেন জয়। তিনি শুক্রবার তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে উৎক্ষেপণ পিছিয়ে যাওয়াকে স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে আখ্যায়িত করে এ ব্যাপারে চিন্তিত না হওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি লেখেন: “উৎক্ষেপণের শেষ মুহূর্তগুলো কম্পিউটার দ্বারা সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। হিসেবে যদি একটুও এদিক সেদিক পাওয়া যায়, তাহলে কম্পিউটার উৎক্ষেপণ থেকে বিরত থাকে। আজ যেমন নির্ধারিত সময়ের ঠিক ৪২ সেকেন্ড আগে নিয়ন্ত্রণকারী কম্পিউটার উৎক্ষেপণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।’

স্পেসএক্সের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানায়, সামান্য ত্রুটির কারণে উৎক্ষেপণ ২৪ ঘণ্টার জন্য স্থগিত করা হয়েছিল।

আজ নির্ধারিত সময়ে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয় বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট। আগামী ১০ দিনে এটি নিয়ে মহাকাশে পৌঁছাবে ‘ফ্যালকন-৯’ রকেট। আরও ২০ দিন পর স্যাটেলাইটটি কাজ করতে শুরু করবে। এটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে বাংলাদেশের গাজীপুর থেকে। এ জন্য গাজীপুরের জয়দেবপুরে তৈরি করা হয়েছে গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশন।

ফ্রান্সের মহাকাশ সংস্থা থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস নির্মিত ৩ দশমিক ৭০ টন ওজনের বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটি সফলভাবে উৎক্ষিপ্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে মহাকাশ রাজত্বে অংশীদার হলো বাংলাদেশ। নিজস্ব স্যাটেলাইটের অধিকারী বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট নিজ কক্ষপথে পরিচালিত হওয়ার পর বাংলাদেশে সম্প্রচার যোগাযোগে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। প্রত্যন্ত এলাকায় ইন্টারনেট সেবা বিস্তৃত করতে ভূমিকা রাখবে এটি।

বাংলাদেশে টেলিভিশন সম্প্রচার খরচ কমবে এই মাধ্যমে। আবার বিদেশি স্যাটেলাইট ভাড়া নিতে হয় বলে যে বিদেশি মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যায়, সেটিও সাশ্রয় হবে।

দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রা যোগ হবে এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটি কাজে লাগানো যাবে।

মহাকাশে অবস্থান

মহাকাশে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের অবস্থান হবে ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। বাংলাদেশের নিজস্ব কক্ষপথ নেই বলে রাশিয়া থেকে ১৫ বছরের জন্য কক্ষপথটি ভাড়া নেয়া হয়েছে। এই কক্ষপথ থেকে বাংলাদেশ ছাড়াও সার্কভুক্ত সব দেশ এবং ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও কাজাখস্তানের কিছু অংশ এই স্যাটেলাইটের আওতায় আসবে।

খরচ ও নির্মাণ

দেশের প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ এই স্যাটেলাইট তৈরিতে খরচ ধরা হয় ২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার ও বাকি ১ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়া হয় বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসি থেকে। তবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হয় ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা।

২০১৫ সালের ২১ অক্টোবর সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় এই ‘স্যাটেলাইট সিস্টেম’ কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর প্রায় দুই হাজার কোটি টাকায় এটি কিনতে থালেসের সঙ্গে চুক্তি করে বিটিআরসি।

স্যাটেলাইট তৈরির পুরো কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়িত হয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তত্ত্বাবধানে। তিনটি ধাপে এই কাজ হয়েছে- স্যাটেলাইটের মূল কাঠামো তৈরি, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি।

নিয়ন্ত্রণ করবে বাংলাদেশ

বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের মূল অবকাঠামো তৈরি করেছে ফ্রান্সের মহাকাশ সংস্থা থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস। স্যাটেলাইট তৈরির কাজ শেষে গত ৩০ মার্চ এটি উৎক্ষেপণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় পাঠানো হয়। সেখানে আরেক মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সের ‘ফ্যালকন-৯’ রকেটে করে আজ স্যাটেলাইটটি যাত্রা করে মহাকাশে।

স্যাটেলাইটটি তৈরি ও ওড়ানোর কাজ বিদেশে সম্পন্ন হলেও এটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে বাংলাদেশ থেকে। এ জন্য গাজীপুরের জয়দেবপুরে তৈরি গ্রাউন্ড কনট্রোল স্টেশন (ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা) স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণের মূল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। আর বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হবে রাঙামাটির বেতবুনিয়া গ্রাউন্ড স্টেশন।

জাতিসংঘের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর আউটার স্পেস অ্যাফেয়ার্সের (ইউএনওওএসএ) হিসাবে, ২০১৭ সাল পর্যন্ত মহাকাশে বিভিন্ন দেশের স্যাটেলাইট ছিল ৪ হাজার ৬৩৫টি। প্রতিবছর ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে স্যাটেলাইটের সংখ্যা। এসব স্যাটেলাইটের কাজের ধরন একেক রকম।

বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটি বিভিন্ন ধরনের মহাকাশ যোগাযোগের কাজে ব্যবহার করা হবে। এ ধরনের স্যাটেলাইটকে বলা হয় ‘জিওস্টেশনারি কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট’। পৃথিবীর ঘূর্ণনের সঙ্গে সঙ্গে এ স্যাটেলাইট মহাকাশে ঘুরতে থাকে।

No comments